ঘাড়ের পিছনে ব্যথার কারণ: এক বিশদ আলোচনা
ঘাড়ের পিছনে ব্যথা (Neck Pain) আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি সাধারণ অথচ অত্যন্ত বিরক্তিকর সমস্যা। এই ব্যথা সামান্য অস্বস্তি থেকে শুরু করে তীব্র যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে, যা আমাদের কাজ, ঘুম এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। অনেকেই একে সাধারণ পেশীর টান ভেবে উপেক্ষা করেন, কিন্তু এর পিছনে লুকিয়ে থাকতে পারে নানান গুরুতর কারণ। ঘাড় আমাদের মেরুদণ্ডের সবচেয়ে নমনীয় অংশ, যা মাথাকে ধরে রাখে এবং এর বিশাল পরিসরের নড়াচড়া নিশ্চিত করে। এই জটিল কাঠামোর কোনো অংশে সমস্যা হলে ব্যথার সৃষ্টি হয়। এই প্রবন্ধে আমরা ঘাড়ের পিছনে ব্যথার বিভিন্ন কারণ, এর লক্ষণ এবং প্রাথমিক সতর্কতাগুলি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
১. জীবনযাত্রা ও অভ্যাসের কারণে ব্যথা: ভুল ভঙ্গিমা ও পেশীর টান (Poor Posture & Muscle Strain)
ঘাড়ের ব্যথার সবচেয়ে প্রচলিত কারণগুলির মধ্যে একটি হলো পেশীর টান (Muscle Strain) এবং দুর্বল অঙ্গবিন্যাস (Poor Posture)। আধুনিক জীবনে, আমরা দীর্ঘ সময় ধরে এক ভঙ্গিতে বসে কাজ করি বা মোবাইল ফোন ব্যবহার করি, যা এই সমস্যার প্রধান কারণ।
টেক্সট নেক এবং দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা
কম্পিউটার বা ল্যাপটপের সামনে একটানা বসে কাজ করার সময় আমরা প্রায়শই মাথা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে রাখি। একইভাবে, মোবাইল ফোন বা ট্যাবলেটে মনোযোগ দিলে মাথা নিচু হয়ে যায়। চিকিৎসা পরিভাষায় এটিকে 'টেক্সট নেক' (Text Neck) বলা হয়। মাথাকে এক ইঞ্চি সামনের দিকে ঝুঁকালে ঘাড়ের ওপর প্রায় ১০ পাউন্ড (৪.৫ কেজি) অতিরিক্ত চাপ পড়ে। দীর্ঘ সময় ধরে ঘাড়কে ভুল অবস্থানে রাখলে ঘাড়ের পেছনের পেশী এবং লিগামেন্টগুলিতে অতিরিক্ত টান পড়ে, রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত হয় এবং তা থেকে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়।
ঘুমের ভুল অবস্থান
ঘুমের সময় ভুল বালিশ ব্যবহার করা বা অস্বস্তিকর অবস্থানে ঘুমানোর কারণেও সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর ঘাড় শক্ত হয়ে যেতে পারে এবং ব্যথা হতে পারে। খুব উঁচু বা খুব নিচু বালিশ ব্যবহার করলে ঘাড় স্বাভাবিক রেখা থেকে সরে যায়, যা পেশীর উপর চাপ সৃষ্টি করে।
মানসিক চাপ ও পেশীর সংকোচন
অতিরিক্ত মানসিক চাপ বা উদ্বেগ (Mental Stress) থাকলে অনেকেই অজান্তেই ঘাড় ও কাঁধের পেশীগুলোকে শক্ত করে রাখেন। এই দীর্ঘস্থায়ী পেশীর সংকোচন (Tension) ঘাড়ের পিছনে ব্যথা এবং শক্ততা (Stiffness) তৈরি করতে পারে।
২. মেরুদণ্ড এবং ডিস্কের ক্ষয়জনিত কারণ (Degenerative Spinal Conditions)
বয়স বাড়ার সাথে সাথে ঘাড়ের মেরুদণ্ড (Cervical Spine)-এর স্বাভাবিক ক্ষয়জনিত পরিবর্তন আসে, যা ব্যথার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। এই পরিবর্তনগুলি প্রায়শই দীর্ঘস্থায়ী ব্যথার জন্ম দেয়।
সারভাইকাল স্পন্ডাইলোসিস
সারভাইকাল স্পন্ডাইলোসিস (Cervical Spondylosis), যা ঘাড়ের বাত (Osteoarthritis of more info the Neck) নামেও পরিচিত, হলো ঘাড়ের কশেরুকা (Vertebrae) এবং ডিস্কগুলির ক্ষয়জনিত রোগ। সময়ের সাথে সাথে ডিস্কগুলি শুকিয়ে যায় এবং সংকুচিত হয়, ফলে কশেরুকার মধ্যে ফাঁক কমে যায়। এই ক্ষয়ের প্রতিক্রিয়ায় হাড়ের কিনারায় অতিরিক্ত বৃদ্ধি বা অস্থি স্পার (Bone Spurs) তৈরি হতে পারে। এই স্পারগুলি যখন মেরুদণ্ড বা স্নায়ুর উপর চাপ ফেলে, তখন ঘাড়ে ব্যথা, শক্ততা এবং নড়াচড়ার সীমাবদ্ধতা দেখা দেয়।
হার্নিয়েটেড ডিস্ক বা স্লিপ ডিস্ক
আমাদের মেরুদণ্ডের কশেরুকাগুলির মধ্যে কুশন হিসেবে কাজ করে ডিস্ক। ক্রমাগত চাপ বা হঠাৎ আঘাতের কারণে এই ডিস্কের ভেতরের নরম অংশটি বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে বা ফুলে যেতে পারে—এই অবস্থাকে হার্নিয়েটেড ডিস্ক (Herniated Disc) বা স্লিপ ডিস্ক বলা হয়। ঘাড়ের অঞ্চলে হার্নিয়েটেড ডিস্ক পার্শ্ববর্তী স্নায়ু মূলে (Nerve Root) চাপ দিলে ঘাড়ের পিছনে তীব্র ব্যথা হয়, যা প্রায়শই কাঁধ, বাহু এবং হাত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এর সাথে হাতে ঝিনঝিন, অসাড়তা (Numbness) বা দুর্বলতা (Weakness) অনুভূত হতে পারে।
স্পাইনাল স্টেনোসিস
স্পাইনাল স্টেনোসিস (Spinal Stenosis) হলো মেরুদণ্ডের নালী (Spinal Canal) সরু হয়ে যাওয়া। এই সরু হয়ে যাওয়া অংশের মধ্যে মেরুদণ্ডের স্নায়ু এবং স্পাইনাল কর্ডের উপর চাপ সৃষ্টি হয়, যা ঘাড়ের পিছনে ব্যথা, শক্ততা এবং শরীরের অন্যান্য অংশে (বিশেষ করে হাত ও পায়ে) স্নায়বিক উপসর্গ তৈরি করতে পারে।
৩. আঘাতজনিত কারণ (Traumatic Injuries)
আকস্মিক আঘাত বা ট্রমা ঘাড়ের ব্যথার একটি তীব্র কারণ। এই ধরনের ব্যথা সাধারণত তাৎক্ষণিক এবং অসহনীয় হয়।
হুইপ্ল্যাশ ইনজুরি
গাড়ি দুর্ঘটনা, বিশেষ করে পিছন থেকে আঘাত লাগলে মাথা হঠাৎ করে প্রচণ্ড গতিতে সামনে-পিছনে বা পাশে সরে যায়। এই দ্রুত ঝাঁকুনিতে ঘাড়ের পেশী, লিগামেন্ট এবং টেন্ডনগুলিতে মারাত্মকভাবে টান পড়ে বা ছিঁড়ে যায়, যা হুইপ্ল্যাশ (Whiplash) ইনজুরি নামে পরিচিত। হুইপ্ল্যাশ ঘাড়ের পিছনে তীব্র ব্যথা, শক্ততা এবং মাথাব্যথা সৃষ্টি করে।
খেলাধুলা বা পড়ে যাওয়া
খেলাধুলার সময় সংঘর্ষ, হঠাৎ পড়ে যাওয়া বা স্লিপ-ট্রিপের কারণে ঘাড়ে সরাসরি আঘাত লাগলে হাড় ভেঙে যাওয়া বা নরম টিস্যু (Soft Tissue) ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মতো গুরুতর সমস্যা হতে পারে, যার ফলস্বরূপ ঘাড়ে তীব্র ব্যথা হয়।
৪. অন্যান্য স্বাস্থ্যগত কারণ (Other Medical Conditions)
কিছু ক্ষেত্রে, ঘাড়ের পিছনে ব্যথা অন্য রোগের লক্ষণ হিসেবে দেখা দিতে পারে, যা উপেক্ষা করা উচিত নয়।
ফাইব্রোমায়ালজিয়া
ফাইব্রোমায়ালজিয়া (Fibromyalgia) একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ, যা শরীরের বিভিন্ন অংশে বিস্তৃত ব্যথা, কোমলতা (Tenderness) এবং ক্লান্তি সৃষ্টি করে। ঘাড়ের পেশীগুলি এই ব্যথার একটি সাধারণ কেন্দ্রবিন্দু।
মেনিনজাইটিস এবং সংক্রমণ
মেনিনজাইটিস (Meningitis) হলো মস্তিষ্কের আবরণের প্রদাহ। এর অন্যতম প্রধান লক্ষণ হলো তীব্র ঘাড় ব্যথা এবং শক্ত হয়ে যাওয়া, যার সাথে জ্বর, তীব্র মাথাব্যথা এবং বমি বমি ভাব থাকতে পারে। এটি একটি জরুরি চিকিৎসা অবস্থা।
টিউমার ও ক্যান্সার
বিরল ক্ষেত্রে, মেরুদণ্ডে বা তার আশেপাশে কোনো টিউমার, সিস্ট বা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি (Abnormal Growth) স্নায়ুর উপর চাপ দিলে বা হাড়ের ক্ষতি করলে ঘাড়ের পিছনে ব্যথা সৃষ্টি হতে পারে।
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি? (When to See a Doctor)
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘাড়ের ব্যথা বিশ্রাম, তাপ/ঠান্ডা সেঁক এবং ওভার-দ্য-কাউন্টার পেইনকিলার দিয়ে নিরাময় করা সম্ভব। তবে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলি দেখা দিলে দ্রুত একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত:
যদি ব্যথা এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলতে থাকে এবং তীব্রতা না কমে।
যদি ঘাড়ের ব্যথা কাঁধ, বাহু বা হাত পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়।
যদি ব্যথার সাথে হাতে বা পায়ে অসাড়তা, দুর্বলতা বা ঝিনঝিন অনুভব হয়।
যদি আঘাত বা দুর্ঘটনার পরে হঠাৎ করে তীব্র ব্যথা শুরু হয়।
যদি ব্যথার সাথে জ্বর, বমি বমি ভাব, মাথাব্যথা, বা অন্ত্র/মূত্রাশয়ের নিয়ন্ত্রণ হারানোর মতো লক্ষণ দেখা যায়।
ঘাড়ের ব্যথাকে কখনই হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়। সঠিক সময়ে রোগের কারণ নির্ণয় এবং চিকিৎসা গ্রহণ করলে দীর্ঘমেয়াদী জটিলতা এড়ানো সম্ভব। তাই, আপনার জীবনযাত্রায় সঠিক অভ্যাস গড়ে তুলুন, ergonomic নিয়ম মেনে চলুন এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের সহায়তা নিন। আপনার ঘাড়কে সুস্থ রাখুন!